এলাকায় হঠাৎ একদিন সাড়া পরে গেল যে সালেহিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কেউ বলল সে হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে, কেউ বলল সে গুম হয়েছে, কেউ বলল জিনেরা তাকে তাদের দেশে নিয়ে গেছে, কেউ বলল সে হয়তো রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে। তার পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজা খুজির পর এলাকায় মাইকিং করার ব্যবস্থা করলেন । তাতে কোন লাভ হল না । পরে এই নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকা পর্যন্ত গড়াল, তাতেও কোন সাড়া পাওয়া গেলনা। একদিন সালেহির এক আত্মীয় তার মাকে একজন কবিরাজের কাছে যেতে বলল, যাতে কবিরাজ সালেহির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তাকে জানতে পারেন। তিনি তাই করলেন। কবিরাজ প্রায় ৩০ মিনিট পর সালেহির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তার মাকে জানালেন। পরে সেই স্থানে সালেহিকে না পাওয়া গেলে সালেহির মা আবারও কবিরাজের কাছে গেলেন। সে বলল যে, আপনারা ওই স্থানে পৌঁছানোর কিছু আগে জিনেরা তাকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে। এভাবে কবিরাজের দেওয়া তথ্যমতে কয়েকবার সালেহির অনুসন্ধানের পর তার পরিবারের সদস্যদের ভুল ভাঙলো।
এর প্রায় ২মাস পর একদিন সন্ধ্যায় সালেহি বাড়ি ফিরে আসলেন। পরিবারের সদস্যরা খুব আনন্দিত হলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন যে, সে এতদিন কোথায় ছিল? তাকে গুম করা হয়েছিল কিনা? কেন সে এতদিন বাড়ির বাহিরে থাকল? ইত্যাদি প্রশ্ন। এতদিন সালেহি কোথায় ছিল, কি খেয়েছিলো, কোথায় গিয়েছিলো এসব তথ্যের কোন কিছু সে মনে করতে পারল না। যারা বলেছিল সালেহিকে জিনেরা নিয়ে গেছে তাদের ধারণা আরোও পোক্ত হল, কবিরাজের কথার সাথেও মিল পাওয়া গেল। ফলে সবাই মোটামোটি বিশ্বাস করে নিল যে জিনেরা সালেহিকে তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল এবং অনুমান করা হল যে, সালেহি যাতে জিনের দেশের অবস্থান কোন মানুষ কে না বলতে পারে তাই তারা তার মস্তিষ্ক থেকে সেই স্মৃতি মুছে দিয়েছে।
এতদিনে সালেহির শারীরিক স্বাস্থ্যের কিছুটা অবনতি দেখে পরিবারের সদস্যরা তাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর সালেহিকে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। প্রথমে কেউ সালেহিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে না চাইলেও সালেহির বড় ভাইয়ের অনুরোধে তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার সালেহির এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রায় এক ঘন্টা কথা বলার পর তাদেরকে জানালেন যে, সালেহি বিচ্ছিন্নতামূলক স্মৃতিভ্ৰংশ বা ডিসোসিয়েটিভে এমনেশিয়া (According to DSM-5: Dissociative Amnesia; with dissociative fugue) নামক একটি মানসিক রোগে ভুগছেন। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি একটি পীড়নমূলক পরিস্থিতির পর থেকে হঠাৎ করেই তার ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য স্মরণ করতে পারে না।
তিনি আরো বললেন যে, বিচ্ছিন্নতামূলক স্মৃতিভ্রংশ রোগটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই কোন একটি পীড়নমূলক অভিজ্ঞতার পর সৃষ্টি হয় যেমন; দাম্পত্য কলহ, ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। সালেহির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাবার মৃত্যু পীড়নমূলক অভিজ্ঞতা হিসাবে কাজ করেছে। বিচ্ছিন্নতামূলক স্মৃতিভ্রংশ রোগে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের তথ্যগুলো চিরতরে হারিয়ে যায় না, শুধু বিস্মৃতির পর্যায় যখন চলতে থাকে তখন ব্যক্তি সে তথ্যগুলো দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি ভান্ডার থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারেনা।
বিস্মৃতির ফলে ব্যক্তির আচরণে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। যেমন: সে স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে , উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে। অথবা ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে তার অতীত জীবনের ঘটনাবলী ভুলে যেতে পারে এবং সে হঠাৎ করে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে এবং অন্য কোন স্থানে গিয়ে একটি নতুন পরিচয়ে কাজকর্ম করতে শুরু করতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য সব আচরণে কোন বিচ্যুতি বা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় না। সামগ্রিক স্মৃতিভ্রংশ দেখা দিলে, রোগী তার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকে চিনতে পারে না, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলতে পারে, বই পড়তে পারে যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করতে পারে, এবং পূর্বে যেসব দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করেছিল সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। বিস্মৃতির উপাখ্যানটি কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই স্মৃতিভ্রংশ থেকে মুক্ত হতে কতদিন লাগবে তা বলা যায় না। যদিও একদিন ব্যক্তির স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসে, কিন্তু তার পলাতক জীবনের ঘটনাগুলো বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যায়।
বিচ্ছিন্নতামূলক স্মৃতি ভ্ৰংশ রোগের চিকিৎসার জন্য কবিরাজের কাছে না গিয়ে একজন মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
লেখক: মোঃ আবু তারেক, সাইকোলজিস্ট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
|